সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
আর কতটা পথ হাঁটতে হবে আমাদের নারীর ব্যাপারে ভ‚মিকা বদলের জন্য? কতটা পথই বা আমরা হেঁটেছি ইতোমধ্যে? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। পতাকা উড়িয়ে, মাইক বাজিয়ে, ঘটা করে আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করি প্রতি বছরই। উৎসবের ঘনঘটার কোনো কমতি নেই, আবার জনজীবনে বিশেষ করে নারীর জীবনে আঁধার নামতেও কোনো কমতি নেই। যত ভিড়, ততই যেন নির্জনতা। বাংলাদেশে মেয়েদের নিয়ে আশঙ্কার জায়গাটি কমছে না, বরং তা যেন বেড়েই চলেছে সময়ের হাত ধরে। আজও সমাজে নারীকে স্বাধীনতা দিতে হয়। তাদের জন্য ‘পুরুষের মতো করে স্বাধীনতা’ নিজে অর্জনের বস্তু নয়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার তো কোনো সীমাবদ্ধতা থাকার কথা নয়। কিন্তু কেউ তা দিতে গেলে, সেই দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধতা থাকবেই। সেই সীমাবদ্ধতার হাত ধরে আজও আমাদের সমাজে মেয়েরা স্বাধীন নন। তাদের মতামত, জীবনযাপন, কাজ, শিল্পকর্ম, ভালোবাসা এবং যৌনতার সবটুকু স্বাধীনতাই পুরুষতন্ত্রের অনুমোদন সাপেক্ষ। ভয় এবং শাসন তাকে আজও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মেয়ে শিল্পী হোক, সাহিত্যিক হোক, কবি হোকÑ সত্যি বলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তার আজও আছে। মেয়েরা হাত খুলে লিখলে সবাই ভেবে বসেন, লেখিকার ব্যক্তিগত জীবন বুঝি অসংলগ্ন। পুরুষ লিখতে পারে রঙিন জীবনযাপনের কথা, কিন্তু নারী লেখকের কলমে থাকবে সেন্সরশিপের কালি। অসাম্যের এ বিধানটা সবসময়ই ছিল এবং আজও আছে।
পুরুষ-মহিলা সাম্যের নিরিখে পিছিয়ে আছে। লিঙ্গ বৈষম্যের সূচকে বাংলাদেশের স্থান ক্রমশই লজ্জাজনক অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে। বাংলাদেশে নারীদের স্বাধীনতা এখনো পড়ে আছে পুরুষদের ছাড় দেওয়ার মধ্যে। আজও স্বাধীনতা অর্জন করে নিতে পারছেন না বাংলাদেশের নারীরা। পুরুষ তাকে যেটুকু ভিক্ষা দিচ্ছেন, নারী তাকেই তার স্বাধীনতা নামের বিলাসিতা ভেবে গ্রহণ করছেন। রায় প্রকাশিত হয়েই গিয়েছেÑ নারী হচ্ছে অসাম্য সমাজের এক নির্ধারিত শাস্তির প্রতিনিধি। নারী মা হতে পারছেন, স্ত্রী হতে পারছেন, কিন্তু এখনো মানুষ হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করতে পারছেন না। তাইতো পাচার হয়ে যাওয়া নারীর প্রশ্ন আজও প্রশ্ন হয়েই থাকছে। উত্তরের নিশ্চিত কাহিনির জন্ম হচ্ছে না। এখনো নারী ধর্ষিতা হয়ে বদনাম ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছেনÑ ধর্ষণের কারণ হিসেবে তার আচার-আচরণই নাকি দায়ী! মহিলাদের ধর্ষণের কারণ হিসেবে পুরুষকে দায়ী না করে মহিলাদের আচার-আচরণ এবং পোশাককে দায়ী করে বড় বড় বিবৃতি দিয়ে বসছেন আজকের কোনো কোনো সমাজের বীরপুরুষরা। এসব কারণেই যেখানে আমাদের সমাজে শ্রমজীবী নারীর সংখ্যা অনেকগুণ বেশি বৃদ্ধির কথা ছিল, সেখানে তাতো বাড়েইনি, বরং কর্মীবাহিনীতে মেয়েদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে মেয়েরা উৎপাদনের কাজ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। শহরে এবং গ্রামে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিনা বেতনে মেয়েদের গৃহস্থালীর কাজে পরিশ্রম।
মেয়েদের এ লড়াই ঠিক আজ শুরু হয়নি। আজ থেকে বহু যুগ আগে অধিকার অর্জনের লড়াই শুরু হয়েছিল মেয়েদের। বৈষম্য কোথাও হয়তো একটু কমেছে। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে, বৈষম্য আছে বলে আজও আদায়ের প্রশ্ন উঠছে। এ আলো সরল রৈখিকভাবে সোজাসুজি এসে পৌঁছায়নি, বেঁকে-চুড়ে, দুমড়ে-মুচড়ে এসেছে। মেয়েদের জন্য আলোকিত বৃত্ত এখনো কোথাও কোথাও গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। আজও কোথাও কোথাও হত্যা, ধর্ষণ, নিগ্রহসহ যাবতীয় ভয়ঙ্কর সব কালো হাত ঘুরিয়ে দিচ্ছে মেয়েদের আলোর গতিপথ। ‘শাট আপ’ বলে তার চারপাশে একটি শক্ত লোহার গেট টেনে দিয়ে পুরুষ তার শক্তসামর্থ উপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। সৃষ্টি হচ্ছে নারীর সয়ে যাওয়ার সমাজব্যবস্থা। সমাজের এ নিয়ম মেনে নেয় সমাজের নারী-পুরুষ, পিতা-মাতা সবাই। এখানেই সমাজব্যবস্থার ঐতিহাসিক ত্রæটি। প্রচলিত সমাজব্যবস্থা মেয়েদের যথাযোগ্য আর্থ-সামাজিক মর্যাদা রক্ষার অন্তরায়। কষ্টের কথা, সমাজের সবাই তা মেনে নিচ্ছে নীরবে। এমনকি এ নিয়মে যাদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি, সেই মহিলারাও এর বাইরে দেখার প্রয়াস পাচ্ছেন না।
তারপরও হয়ে যায় কোথাও কোথাও ব্যতিক্রম। সেই ব্যতিক্রমের হাত ধরে সৌদি আরবের মতো দেশেও জন্ম নেন অগ্নিকন্যা লুইজেন, বাংলাদেশে সাহস দেখান রুবিনা আর নুসরাতের মতো খেটে খাওয়া নারীরা, পাকিস্তানে জন্ম নেন মালালা, মিশরে মহিলা ক্যাপ্টেন মারওয়া এলসহেলদার জাহাজ চালান মাঝসমুদ্রে, জম্মু ও কাশ্মীরে বাস চালিয়ে চমক দেন বাস ড্রাইভার পূজা দেবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রশিক্ষণের জন্য বেছে নিতে বাধ্য হয় প্রথম নারী মহাকাশচারী নোরা আল-মাক্রশিকে। ভারতবর্ষের কাদম্বিনী, বাংলাদেশের বেগম রোকেয়াসহ অগণিত কিছু ব্যতিক্রমী নারী চরিত্রও আমাদেরকে চমকে দেয় মাঝেমধ্যে।
হয়তো গলা ফাটিয়ে বলতে পারিনি কখনও নারী জাগরণের কথা। কিন্তু যেটুকু কথা বলতে চাই, তা দিয়ে সাজিয়ে দিলাম নারীর জয়গানে ভরপুর কয়েকটি প্রবন্ধ সম্বলিত এ বইটি। স্বপ্ন দেখা ছেড়ে না দেওয়ার প্রয়াসে কিছু উদাহরণ তুলে ধরলাম। পাশাপাশি মহিলাদের নিয়ে সমাজে চলে আসা অনিয়মগুলিও তুলে ধরলাম। যদি তাতে মহিলা ও পুরুষদের ভ‚মিকা বদলের কথা মনে হয়; যদি সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের তাগিদ কারো মনে উঁকি দেয়Ñ এমনই প্রয়াস।