সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
যে বিশ্বে আমরা বাস করছি তা আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে আবির্ভাব হয়েছিল। আজ আমরা যে মানুষগুলো বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি, তার উত্তরসূরীরা ৪৪ লক্ষ বছর পূর্বে পৃথিবীতে আগমন করেছিল। ২০ লক্ষ বছর পূর্বে মানুষ জাতির কেউ কেউ পাথর দিয়ে দ্রব্যাদি তৈরি করতে শিখেছিল। বিবর্তনের হাত ধরে পৃথিবীর মানুষ এগিয়েছে সামনের দিকে। সভ্যতা হাঁটি হাঁটি পা পা করে অগ্রসর হয়েছে সংস্কৃতি, ভাষা, সমাজ আর ধর্মের ক্ষেত্রে। সেই ইতিহাসের কথাই বলছে এ বইটি। আধুনিক সভ্যতার পূর্ব পর্যন্ত সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ক্রমবিকাশকে সম্বল করে আমার প্রয়াস ‘বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস’ বইটি।
লেখকের মর্মকথা পড়েই বইটি পাশে সরিয়ে রাখার মতো নয়। অনুধাবন করুন লেখকের প্রয়াস এবং সুগঠিত ও সুপঠিতভাবে আমাদের মনের খোরাক যোগাতে কোন পর্যায়ে হাত দিয়েছেন। ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই, যা পড়া শুরু করলে পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিবে।
লেখকের কথা:
আমরা বিশ্ব ইতিহাস অবজ্ঞা করতে পারি না। ইতিহাস আজকের বিশ্বের উন্নয়নের কালানুক্রমিক জীবনচারিতা। আমাদের সভ্যতার মূলে রয়েছে উন্নয়ন যা ঘটেছিল পশ্চিম এশিয়ার দূরবর্তী দেশগুলোতে ছয় হাজারেরও বেশি বছর পূর্বে। প্রাচীন লেখকদের নিকট অঞ্চলটি মেসোপটেমিয়া হিসেবে পরিচিত। এটি টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মাঝে অবস্থিত একটি দেশ যা ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরনো সভ্যতার একটি। এটি তথাকথিত সমৃদ্ধ ক্রিসেন্টের এবং প্রাচ্যের শেষ অংশে সমৃদ্ধি লাভ করেছিল, যা মিশরের দিকে পশ্চিমাভিমুখে বিস্তৃত ছিল। সেই সময়ের মানুষের বিশ্বাস অনুসারে, এই রূঢ় ভ‚দৃশ্যে ঈশ্বরের সম্পত্তি হিসেবে প্রথম নগরগুলো আবিভর্‚ত হয়েছিল, যিনি রাজাদেরকে মানুষের জন্য সেই সম্পদ আহরনের ক্ষমতা মঞ্জুর করেছিলেন। নগর সভ্যতার গুরুত্ব বহন করা মন্দির ও প্রাসাদের প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকি ও সুশোভিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল নগর সভ্যতার মানুষগুলো এবং তা রাজাদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়নের আবিষ্কারগুলো লেখা হিসেবে থেকে যাওয়ায় পরবর্তীতে ঐতিহাসিকগণ তা আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। এসব ছিল স্মারক স্থাপত্যের সৃষ্টি এবং ঈশ্বর ও শাসকদের সেবায় পুষ্পোদগম শিল্প। মেসোপটেমিয়াতে কার্যকর অসাধারণ নব উদ্ভাবনগুলো অ্যানাটুলিয়া, সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী ভ‚মধ্যসাগরের পূর্বাংশ, ইরান ও উপসাগরের চারপাশের সংস্কৃতির উন্নয়ণে সুগভীর প্রভাব ফেলেছিল। দুর্লভ ও মূল্যবান উপাদান যেমন- নীলা, গাঢ় নীলবর্ণ মূল্যবান পাথর, স্বর্ণ, রূপা ও আইভরি ইরান, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া উপসাগর ও আরব সাগরব্যাপী দূরবর্তী অঞ্চলে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময় উৎসাহিত করেছিল।
মেসোপটেমিয়ার কেন্দ্রভ‚মি ও এশিয়ার বিস্তৃত এলাকাব্যাপী বিশ্ব ইতিহাসের এই প্রজনক সময়ের সর্বোচ্চ ঐতিহাসিক অর্জনগুলো ঐতিহাসিকগণ পরবর্তীতে অন্বেষণ করেছেন। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় মিলেনিয়ামের পদানুবর্তী পুরনো রাজবংশ এক্কাদিয়ান ও উর-৩ এর সময়গুলোতে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য মেসোপটেমিয়াতে প্রথম সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজাগণ তাদের ঈশ্বরের মন্দির নির্মাণ করে এবং যুদ্ধে সেনাবাহিনীদের নেতৃত্ব দিয়ে তাদের অর্জনগুলো ধর্মীয় সেবা দিয়ে উদযাপন করার মাধ্যমে তাদের শাসন গৌরবান্বিত করেছিলেন। ঈশ্বরকে ব্যতিক্রম উপাদান উৎসর্গ করে স্বর্গীয় সমর্থন রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল। এগুলো আবেগভরা কর্মসহ পূজারী হিসেবে শাসকদের অবস্থা নিশ্চিত করেছিল।
প্রাচ্যের প্রাচীন ভাষা ও লেখা পদ্ধতি উভয়ই ত্রæটিপূর্ণভাবে ধরা দিয়েছিল। পন্ডিতগণ তাদের প্রতিলিপির ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হতে পারেন নি। এই বইয়ে সাধারণভাবে ব্যবহৃত প্রতিলিপি অনুসারে নাম, বিষয়, ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। এই বইয়ে অধিকাংশ তারিখগুলো সাধারণভাবে পাওয়া যায় এমন তথ্য থেকে নেয়া হয়েছে। বইটিতে ব্যক্তিগত বিষয় বা শাসকদের নির্দিষ্ট তারিখ না বলে বছরের হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম উদাহরণগুলো বলা হয়েছে যার মধ্যে প্রথম পুরনো সংস্কৃতি নগর ও পরে রাষ্ট্রে সংযুক্ত হয়েছিল, যার ওপর সকল পদানুবর্তী সমাজগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। এটির সমৃদ্ধ ও শিল্পীসুলভ ঐতিহ্যগুলো এই বইয়ের কেন্দ্রবিন্দু, যা মানুষের স্বভাব, ধর্মের প্রকৃতি এবং দর্শন বিবেচনায় মূল প্রশ্নের উত্তরে সাধারণ উপাদান ও মহাবৈচিত্র্য উভয়ই প্রকাশ করে।
যদিও সময় ও স্থান দূরবর্তী, তবুও দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার নগর সংস্কার দ্বারা প্রতিনিধিত্ব নগর বিপ্লবকে অবশ্যই মানবতার সংজ্ঞায়িত মুহূর্তগুলোর একটি হিসেবে দেখতে হবে। সভ্যতার এই মিশ্র কেন্দ্রগুলো যা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর সীমান্তে উর্বর সমভ‚মিতে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ মিলেনিয়ামের শেষের দিকে জেগে উঠেছিল, তা বড় আবিষ্কারগুলো প্রকাশ করেছিল। যেমন লেখা ও শিল্পীসুলভ অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল। এই উন্নয়নের বেশিরভাগই ঈশ্বরের প্রতি ধর্মানুরাগ প্রদর্শন করেছিল। রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, উপাদান ও পণ্যের প্রবাহ যা সমাজকে বহন ও সুশোভিত করেছিল তা আহরণ, উদ্ভাবন, সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করতে বিস্তারিত আয়োজনের স্বাক্ষর পাওয়া গিয়েছিল। মেসোপটেমিয়াতে এই অগ্রগতির ফলে আংশিকভাবে অন্য প্রধান সভ্যতাগুলো সমুদ্র ও ভ‚মিপথ যা একে অপরের সাথে সংযুক্ত ছিল তা উন্নত হয়েছিল। এ বই পূর্ব মধ্যভ‚মির কাছাকাছি নগরের অসাধারণ উন্নয়ন ও তাদের প্রভাব এবং পূর্ব ও পশ্চিমে সমসামরিক সভ্যতা থেকে আহরিত উদ্দীপনার কিছু বর্ণনা করার চেষ্টা করেছে। যাহোক, আমরা প্রতœতত্ত¡বিদদের চেষ্টার ফলে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় মিলেনিয়ামের বিশ্বের মন্দির, প্রাসাদ ও সামাজিক অভিজাতদের সমাধির পুনরুদ্ধারকৃত উপাদানগুলো দেখতে পাই। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শস্য উৎপাদনকারী দেশ ব্যাবিলিনিয়ার উর্বরতা প্রচুর গম, তিল অবিশ্বাস্য আকারে উৎপন্ন করেছিল। এই দেশটি গ্রীষ্ম ও আক্কাদ হিসেবে পরিচিত এবং পরবর্তীতে ব্যাবিলন নগর হিসেবে নামকরণ করা হয়েছিল। এটি ভ‚-দৃশ্যের দক্ষিণ অংশকে পরিবেষ্টন করেছে, যা পরবর্তী গ্রীক উৎসে মেসোপটেমিয়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভ‚-গোল ছিল নিরূপক বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম, যা দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ানের প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি উন্নত করেছিল। সমতল ভ‚মি ও নদী চ্যানেলগুলো সমন্বয় বিধান ও যোগাযোগ উন্নত করেছিল। টাইগ্রিসের মুখের প্রায় ১৮০০ মাইল পূর্বে ইন্দাস নদী ব্যবস্থা দ্বারা গঠিত অন্য একটি বড় সমভ‚মিতে হরপ্পা সভ্যতা জেগে ওঠেছিল। ইন্দাস নদী ইউফ্রেটিস থেকে সামান্য দীর্ঘ। এটি তিব্বতের উত্তর পর্বত থেকে আরব সাগরের মুখে করাচীর দক্ষিণ জেলা ব-দ্বীপ পর্যন্ত প্রবাহিত। ইন্দাস নদী অনেক দেশকেও সমৃদ্ধ করেছিল। পাঞ্জাব ও সিন্ধু সমভ‚মিতে সমৃদ্ধি এনে ইন্দাস একটি পর্যাপ্ত কৃষিজাতীয় এলাকা সৃষ্টি করেছিল, যা নগরগুলোর ভার বহন করেছিল যেমন- মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা।
এ বইটি অনেক ঐতিহাসিক বই ও লেখা, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও পুরনো সংকেত ও চিত্রসহ অনেক পরিচিত উৎস থেকে সাহায্য নিয়ে করা হয়েছে। মাঝে মাঝে সাহায্য ছিল উল্লেখযোগ্য; মূল বিষয়ে সরাসরি ফোকাস করেছে। এই বই শুধুমাত্র উন্নয়নের কথা বলেছে, যা এই বিশ্ব আধুনিক ইতিহাসের পূর্বে অর্জন করেছে। এটি মানব সংস্কারের দিনগুলো থেকে আধুনিক সভ্যতার পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মানবতা এবং অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, সম্পদ ও আচরণের ক্ষেত্রে উন্নয়ন হিসাব করেছে। পাঠকের সবিনয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই যে এই বইয়ের সময় জ্ঞান উপলব্ধি করতে খ্রীষ্টপূর্ব এবং খ্রীষ্টাব্দ ধারনাটি সব সময় মনে রাখতে হবে।
১৯২০ সালের শেষে অসচরাচর, অতি উঁচু মানের উপাদান বেশি পরিমাণে বাগদাদে পুরাতত্ত¡ ডিলারদের দোকানগুলোতে প্রতীয়মান হতে শুরু করল। টাইগ্্িরসের সাথে সংগমস্থলের ঠিক উত্তরে দায়ালা নদীর পূর্ব মরুভ‚মির অবৈধ গহŸর থেকে এসব সম্পদ আসার কথা বলা হয়ে থাকে। ১৯২৯ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট ওই এলাকায় খনন করতে সুবিধা অর্জন করেছিল। পেন্সিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত¡ ও নৃবিদ্যা জাদুঘর, বোস্টনের প্রাচ্যসংক্রান্ত গবেষণায় নিয়োজিত ফিলাডেলফিয়া ও আমেরিকান স্কুলগুলোর যুগ্ম পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৩৭ ও ১৯৩৮ সালে দুটি অতিরিক্ত সংক্ষিপ্ত অভিযানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট বিশাল আনুভ‚মিক ও উলম্ব খনন পরিচালনা করেছিল- খাফাজাহ্, টেল আসমার (প্রাচীন অ্যাসনোমা), টেল আগবের ও ইশচালি এই চারটি ঢিবির ওপর। অভিযানটি প্রায় ৩১০০ থেকে ১৭৫০ খ্রীষ্টপূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত মন্দির, প্রাসাদ, প্রশাসনিক ভবন ও ব্যক্তিগত বাড়ি-ঘর উন্মোচন করেছিল। ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটের কাজ প্রতœতাত্তি¡ক পরিসংখ্যান ও আঞ্চলিক গবেষণা অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সময়ের ব্যবধানে এটি অনেক ক্ষেত্রে ছিল উদ্ভাবনী এবং এটি তথ্যসম্পদ সরবরাহ করেছিল যা ছিল পুরনো মেসোপটেমিয় সভ্যতার গবেষণায় মূল উপাদান।
সম্ভবত দায়ালা অঞ্চলে ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউটটের কাজের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অবদান ছিল মেসোপটেমিয়াতে পুরনো রাজবংশের চিহ্ন। খাফাজাহ্ ও টেল আসমার ছয়টি সমান্তরাল স্থানে খনন করা হয়েছিল, যা আক্কাদিয়ান রাজা সারগনের যুগের (২৩০০-২২৪৫ খ্রীষ্টপূর্ব) সাথে ওই স্থানগুলোতে সবচেয়ে পুরনো অবশিষ্টাংশগুলোকে যুক্ত করেছিল। মেসোপটেমিয়া, মিশর এবং ইন্দাস সভ্যতাই একসময় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আধুনিক সভ্যতার বীজ বপন করেছিল। আজকের বিশ্ব তাই ঋণী হয়ে আছে অতীতের এই তিনটি সভ্যতার কাছে।