সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
প্রজাপতিকে আমরা সবাই ভালোবাসি তার অনিন্দ্য সুন্দর অবয়বের কারণে। রূপান্তরের সবচেয়ে বড় উদাহরণ প্রজাপতি। কারণ তার আগের রূপটাকে আমরা কেউ ভালোবাসতে পারি না। খোলস ছেড়ে শুঁয়োপোকা যখন বেরিয়ে আসে, তখন সে হয়ে যায় অনিন্দ্য সুন্দর প্রজাপতি। সবসময় এমন ভালো পরিবর্তন না-ও হতে পারে। পরিবর্তনে সুদিনও আসতে পারে, আবার কোনো কোনো পরিবর্তনে দুর্দিনও আসতে পারে। পরিবর্তনে অমানুষ যেমন মানুষ হয়ে উঠতে পারে, তেমনি মানুষও অমানুষ হয়ে উঠতে পারে। যুগে যুগে দেশে দেশে গণবিপ্লব রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছে। সেখানে কোথাও ঘটেছে পরিবর্তন, আবার কোথাও ঘটেছে রূপান্তর। ভারতবর্ষের রূপান্তর ঘটেছিল। ভারত আর পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক রূপান্তরের মাধ্যমে। ভারত কিংবা পাকিস্তান কেউই ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের মতবাদ ধারণ করে চলেনি। একেবারেই রূপান্তরিত ভারত এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ভারতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। পাকিস্তান হেঁটেছিল ভিন্ন পথে। ধর্ম দিয়ে পরিচিত করতে চাইল পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থা। কিন্তু একদিন তাদের ভাগ্যাকাশেও রূপান্তরের সুযোগটা এসে গেল ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের হাতে। তবে বাংলাদেশও খুব বেশিদিন হাঁটতে পারেনি স্বাচ্ছন্দ্যভাবে সেই রূপান্তরের সঙ্গে। হোঁচট খেয়েছে বারবার। বাঙালির আকাশকে, তার ভৌগোলিক বোধকে, সত্ত¡ার বিশিষ্ট রাজনৈতিক সংজ্ঞাকে বিভাজিত এবং কলুষিত করতে চেয়েছে বারবার। তারপরও আমাদের নিজস্ব ভাষাটুকু এখনো বেঁচে আছে। তারপরও আত্মচৈতন্যে আমরা মগ্ন হয়ে বলিÑ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।
গল্পটি ঠিক গল্প নয়, কঠিন জীবন সত্য। শেষ ফাল্গুনের বেলায় অনেক্ষণ পথ চলতে চলতে ছেলেটির তেষ্টা পেয়েছিল। বয়স তার ১৩ কী ১৪ বছর! রাস্তার ধারে বড়সড় একটি মন্দির। পানি পান করতে সেখানে ঢুকে সে। বেধরক মার খায় ছেলেটি। তার অপরাধÑ সে ধর্মে মুসলমান। মন্দিরের দরজায় পরিষ্কার লেখা আছে,‘হিন্দু ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ’। ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের ঘটনা এটি। মারধরের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মন্দিরের কর্তারা সাফ জানিয়ে দিলেন, তাদের মন্দিরে ‘ওরা’ ঢুকবে না, ব্যাস! কিন্তু গল্পের এখানেই শেষ নয়। সংবাদপত্র এগিয়ে চলে; ক্যামেরার সামনে আসে মার-খাওয়া কিশোরের স্বজনরা। তার দিনমজুর বাবা নিচু গলায় ছেলেরই দোষ স্বীকার করে নেনÑ লেখাপড়া জানে না, তাই লেখাটি বুঝতে পারেনি। গাজিয়াবাদের ওই অসহায় শ্রমিক পিতার মিনতি যখন বাতাস ভারি করছিল, ঠিক তখনই তার পাশে কারা যেন একজন-দু’জন করে জড়ো হতে লাগল। পাশে এল কিছু মেয়েও। কেউ স্বজন, কেউ প্রতিবেশী, কেউ সমাজকর্মী। সংবাদমাধ্যমে বাবার মুখে মুর্খ ছেলের ভুল করে মন্দিরে প্রবেশের কথা শুনতে শুনতে তারা অচিরেই অস্থির হয়ে ওঠে। বাবাকে থামিয়ে দিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠেÑ বাচ্চা কোনো ভুল করেনি। পানি তেষ্টা পেয়েছিল, পানি খাবে না! মন্দির হোক, মসজিদ হোকÑ কী আসে যায়? এ মেয়েদের কন্ঠে কোনো সংশয় ছিল না, একফোঁটা ভয় ছিল না; গরিব ঘরের এ মেয়েদের তীব্র এবং ¯পষ্ট উচ্চারণ শুনতে শুনতে মনে হয়েছেÑ এ জোরটাই আমাদের আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এ জোরটাই প্রয়োজন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে।
ভয় তো আজ ভয়ঙ্করভাবে আমাদের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাড় হিম করা ভয়! ভয়ের দাপটের চিহ্ন এতটাই ¯পষ্ট যে, অসহায় মানুষগুলো নিজেরাই ভয় পেয়ে গুঁটিয়ে থাকে। আর গুঁটিয়ে থাকাই একসময় তাদের স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়। দেশজুড়ে এ স্বাভাবিক ভয় সঞ্চারিত করে চলারই উৎকট অভিযান দেখছি। সুযোগ পেলেই তারা প্রতিবাদী কন্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে হাতে ধারালো অস্ত্র তুলে নেয়। কিন্তু প্রতিবাদী ওই গাজিয়ানবাদের মেয়েদের সাহসটুকু দেখে মনে হয়, ভয় পেয়ে সিটিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা এখনো হয়নি। দেশজুড়ে বিদ্বেষ দিয়ে মানুষকে ভাগ করার যে তৎপরতা, সেখানে ওই নির্ভীক প্রত্যয়ের কোনো বিকল্প নেই। তাদের মুখের ওপর বলে দিতে হবেÑ ‘লোকের পানির তেষ্টা পেলে যেখানে পানি আছে সেখানেই পানি খাবে।’ এটাই মনুষ্যত্ব, এটাই ইনসানিয়াৎ। সবার আগে ইনসানিয়াৎকে জায়গা দেওয়া প্রয়োজন। যখন মানুষের ক্ষুধা পায়, তখন সেই ক্ষুধাকে ‘হিন্দু ক্ষুধা’ বা ‘মুসলমান ক্ষুধা’ বলে আলাদা করা যায় না। এ কথাগুলো মনে রাখা আমাদের কাজ, আমাদের দায়িত্ব। এটাই হোক আজকের দিনের বিপ্লব, আজকের দিনের সামাজিক রূপান্তর। এ বিশ্বাসেই লেখা কয়েকটি প্রবন্ধ দিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি।